
৯ মের সকালটা একটু অন্যভাবেই এসেছিল একরামুল হকের জীবনে। ১৮ বছরের ছোট্ট জীবনের সেরা দিনটি–বললেও ভুল হবে না। সেদিন যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছেন এই তরুণ। স্বাভাবিকভাবেই দিনটি ছিল তাঁর কাছে সোনায় মোড়ানো। শুধু কি একরামুল। প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরের এক প্রত্যন্ত গ্রামে বসে সেই দিন আবেগে ভেসেছেন আরও একজন মানুষ। তিনি একরামুলের গর্বিত মা মমতাজ বেগম।
একরামুলের সাফল্য মমতাজ বেগমের ছুঁয়ে যাওয়ারই তো কথা। বাঁশখালীর প্রত্যন্ত ছনুয়ার খুদুকখালীর এই গৃহবধূর নিজের পড়ালেখা করা হয়নি। তবে নিজে অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন হলেও ঠিকই ছেলেকে পৌঁছে দিলেন মেডিকেল কলেজের আঙ্গিনায়।
এমন দিনে উচ্ছ্বাস তো তাঁকে ছুঁয়ে যাবেই।মমতাজ বেগম নিজে পড়াশোনা না করলেও সন্তানদের পড়াশোনা নিয়ে ছিলেন খুব সিরিয়াস। বড় ছেলে মো. এমরানুল হককে নিয়েই বড় স্বপ্ন দানা বেঁধেছিল এই মায়ের মনে। কিন্তু সেই স্বপ্নের দৌড় থেমে যায় ছেলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময়েই। বিষয়টি সবাই সহজভাবেই নেন। কেননা প্রত্যন্ত এই গ্রামে এটাই স্বাভাবিক, তেমন কারও স্কুলের গণ্ডি ফেরোনো হয় না এখানে। তবে একজন খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। তিনি হলেন একরামুলের মা। সেদিন মনটাই যেন ভেঙে গিয়েছিল এই নারীর।
তবে দ্রুতই নিজেকে সামলে নেন মমতাজ। তাঁর নতুন সংগ্রাম শুরু হয় মেজ ছেলে একরামুলকে নিয়ে। অবশ্য লবণচাষী বাবার সন্তান একরামুল নিজেও কষ্ট কম করেননি। পড়ালেখা চালিয়ে নিতে চাষবাস, মাছ ধরা থেকে টিউশনি—কীই-বা করেননি এই তরুণ। অভাব-অনটনে একটা সময় তো পড়ালেখাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। তবে মায়ের অনুপ্রেরণা আর সাহস তাঁকে কোনো কিছু থেকেই বিচ্যুতি ঘটাতে পারেনি। মা-ছেলের এই প্রচেষ্টার জয় হয়েছে শেষে। বাধার সব পাহাড় ডিঙিয়ে একরামুল যে পৌঁছে গেলেন নিজের গন্তব্যে। এবার মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া একরামুল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পান। এরপর ৯ মে তিনি ভর্তি হয়েছেন এই মেডিকেলে।
দিনের বেলায় স্কুলের ফাঁকে মাছ ধরা আর বাবাকে মাঠের কাজে সাহায্য করতেন একরামুল। তবে রাত হলেই বাকি সব বাদ দিয়ে মমতাজ বেগম ছেলেকে নিয়ে বসে পড়তেন টেবিলে। এই নিয়মের কোনোদিন ব্যত্যয় হতে দেননি এই মা। মায়ের প্রচেষ্টা, বড় আপু আর চাচির সহযোগিতায় প্রতিটি ক্লাসেই নিজেকে ছাড়িয়ে যান একরামুল।
প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোতেই তাই আরও ভালো কিছুর আশায় তাঁকে ভর্তি করানো হয় বাড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরের নাপোড়া শেখেরখীল উচ্চ বিদ্যালয়ে। কিন্তু অসহায় বাবার সাইকেল কিনে দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। বাধ্য হয়ে তাই তিন মাসের মাথায় তুলনামূলক কাছের পুঁইছড়ি ইজ্জতিয়া আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ে ফিরে আসতে হয় একরামুলকে। এরপর সেখান থেকে এসএসসি পাস করে চলে আসেন শহরে। এইচএসসি পাস করে এক মিনিটও অপচয় করেননি একরামুল।
একরামুল বলেন, ‘২০২১ সালের আগস্ট থেকে এই বছরের মার্চ পর্যন্ত টানা কষ্ট করে গেছি। মা–বাবার দোয়া আর সেই সাত মাসের প্রচেষ্টায় আমাকে মেডিকেলে পৌঁছৈ দিয়েছে। আমি মায়ের কাছে কৃতজ্ঞ। তিনি না হলে অনেক আগেই থেমে যেতাম।'
ছেলে মেডিকেলে ভর্তি হল, খুশির শেষ নেই মমতাজ বেগমের মনে। তবে এর মধ্যেই ছেলেকে দিয়েছেন ভবিষ্যতের শিক্ষা।
মমতাজ বেগম সিভয়েসকে বলেন, ‘নানা কারণে নিজে পড়ালেখা করতে পারিনি। সেটি নিয়ে সারাজীবনই মনোবেদনা আছে। সেই কষ্ট দূর করতে ছেলেদের পড়াশোনা করাতে সব চেষ্টাই করেছি। তাঁদের নিয়ে খুব বড় আশাও দেখেছিলাম। আল্লাহ আমার সেই আশা পূরণ করেছেন। আমার মনটা আরও বড় হবে যখন দেখব–ছেলে পড়াশোনা শেষে একজন পরিপূর্ণ চিকিৎসক হয়ে বিনামূল্যে গ্রামের মানুষদের সেবা করছে।’
মায়ের একটা স্বপ্ন পূরণ করেছেন একরামুল। বাকি স্বপ্নটাও নিশ্চয় একদিন পূরণ করবেন!