
ঢাকা থেকে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা যেতে একসময় পার হতে হতো অনেকগুলো ফেরি। কষ্টের কোনও সীমা ছিল না। যারা ওই রোড পারি দিতেন তারাই জানতেন সেই কষ্টের জ্বালা। তবে কষ্টের দিন শেষ হচ্ছে। শনিবার (২৫ জুন) উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগে উন্মুক্ত হবে এক নতুন দিগন্ত।
রাজধানী ঢাকার সঙ্গে কুয়াকাটার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হচ্ছে। ফলে এই সড়কে বাড়বে যাত্রী ও যানবাহনের চাপ। এতে এই রুটে দুর্ঘটনা বাড়ার শঙ্কা করছেন সড়ক ব্যবহারকারীরা। তবে এসব বিষয় মাথায় রেখে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ)। পাশাপাশি পর্যটন ও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের বিষয়গুলো মাথায় রেখে অগ্রসর হচ্ছেন পটুয়াখালীর ব্যবসায়ীরা।
কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি দেশের পর্যটনেও লাগতে চলেছে নতুন হাওয়া। কুয়াকাটায় জমি কিনে দীর্ঘদিন ফেলে রাখা জমিতে নতুন করে গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছেন নতুন নতুন হোটেল, রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট, যা ঘিরে আরও সমৃদ্ধ হচ্ছে পর্যটন শিল্প। সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে এই সেতু বড় ভূমিকা রাখবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।
দেশের সর্ব দক্ষিণে পটুয়াখালী জেলা। এখানে রয়েছে সাগরকন্যা খ্যাত কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতসহ বিভিন্ন দৃষ্টিনন্দন পর্যটন স্পট। এছাড়া এই এলাকায় গড়ে উঠছে পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা সমুদ্র বন্দর, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ বেশকিছু উন্নয়ন প্রকল্প। পদ্মা সেতুতে যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হলে এই সড়কে যানবাহনের চাপ বাড়বে কয়েকগুণ। আগে ঢাকা থেকে কুয়াকাটা আসতে ১২টি ফেরি পার হয়ে কুয়াকাটা আসতে হতো। বর্তমানে পদ্মা সেতু চালু হলে সড়ক পথে মাত্র পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টায় ঢাকা থেকে সাগরকন্যা সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটায় পৌঁছানো যাবে।
কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোতালেব শরিফ বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটন শিল্পের মানচিত্র পাল্টে দেবে পদ্মা সেতু। দ্রুততম সময়ে আসা যাবে সাগরকন্যা কুয়াকাটা ও ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনে। লঞ্চে বা বাসে কুয়াকাটা আসতে সময় লাগতো ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা। তবে পদ্মা সেতু হয়ে গেলে অর্ধেক সময়েই পৌঁছানো যাবে। গত বছরের অক্টোবরে পটুয়াখালীর লেবুখালী সেতুর উদ্বোধন হওয়ায় এ যাতায়াতে আর কোনও ফেরি থাকলো না। আমরা পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের দিন থেকে আগামী ১৫ দিন কুয়াকাটায় হোটেল মোটেলে রাত্রি যাপনের ভাড়া ৫০% এবং খাবার হোটেলগুলোতে ৩০% ছাড় ঘোষণা দিয়েছি।
জীর্ণ শীর্ণ রঙ বিহীন গাড়িগুলোর পরিবর্তে এখন বিলাস বহুল গাড়ি চলবে। স্বপ্নের রঙিন ছোঁয়ায় ডানা মেলবে পরিবহন খাতও। পরিবহন সেক্টরের মালিকরা নতুন গাড়ি নিয়ে এসে এই পথের যাত্রাকে করতে চায় রোমাঞ্চকর ও আরামদায়ক। আর এই অঞ্চলের রুটে চলবে জার্মানির ‘ম্যান’ ব্র্যান্ডের ডাবল ডেকারের মতো বিলাসবহুল গাড়িও। এছাড়াও নিয়মিত চলবে স্ক্যানিয়া, হুন্দাই ভলভো ব্রান্ডের গাড়িগুলো। যোগযোগ খাতে উন্মুক্ত হবে আরও একটি সম্ভাবনার নতুন দুয়ার।
পটুয়াখালী জেলা বাস মিনিবাস মালিক সমিতির সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন মৃধা বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পাশাপাশি পুরো বাংলাদেশে অর্থনীতির একটা মহাবিপ্লব ঘটবে। সেতু চালু হলে পরিবহন কোম্পানিগুলোর অত্যাধুনিক বাস বিভিন্ন জেলার সঙ্গে চলাচল শুরু করবে। ফলে পরিবহন সেক্টর দেশের প্রধান স্বর্ণময় অবস্থান হয়ে উঠবে। নতুন বাস নামলে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়ে কমবে বেকারত্বও। এছাড়া পণ্যবাহী ট্রাকগুলোকে আর বিড়ম্বনায় পড়তে হবে না। ভাড়া কম লাগবে বলে পণ্যের দামও কমবে। এতে পদ্মা সেতুর সুফল পাবে পুরো দক্ষিণাঞ্চলবাসী। তবে এজন্য সড়কগুলোর সম্প্রসারণ করা, মহাসড়কের পাশ থেকে বাজার স্থানান্তর এবং মহাসড়কে ধীরগতির যানবাহন চলাচল বন্ধ করা প্রয়োজন। না হলে এই সড়কে দুর্ঘটনা এবং প্রাণহানির সংখ্যা বাড়বে।
পটুয়াখালী সড়ক ও জনপথ বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মাসুদ খান বলেন, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় মাওয়া থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত ছয় লেনের সড়কে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে বর্তমানে স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনায় ৩৭ কোটি টাকা ব্যয়ে লেবুখালী ব্রিজ থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত ৮৪ কিলোমিটার সড়ক ঢেলে সাজানো হচ্ছে। এর আওতায় সড়কের বিভিন্ন স্থানের ২৭টি বাঁক সরলীকরণ এবং ২০টি বাজার এলাকার দুইপাশে ১২ ফুট করে সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এদিকে পটুয়াখালী পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী জসিম উদ্দিন আরজু জানান, মহাসড়কের পাশাপাশি জেলা শহরের প্রবেশ পথগুলোকেও সম্প্রসারণের কাজ করছে পটুয়াখালী পৌরসভা। যেহেতু সরকারের বিভিন্ন মেগাপ্রকল্প চলমান এবং জেলা শহরে প্রশাসনিক কার্যালয়গুলো অবস্থিত সে কারণে একটি পোর্ট সিটির আদলে শহরের প্রধান সড়কগুলো এরই মধ্যে চার লেনে সম্প্রসারণের কাজ শেষ পর্যায়ে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কুয়াকাটা পৌর মেয়র মো. আনোয়ার বলেন, পদ্মা সেতু খুলে দেওয়া হলে সড়কপথে ফেরির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে না। ঢাকা থেকে সড়কপথে কুয়াকাটা আসতে ছয় ঘণ্টারও কম সময় লাগবে এবং কুয়াকাটাকে ২৫ জুন উপলক্ষে আলোকসজ্জায় সজ্জিত করার কাজ চলমান আছে।
সাগরকন্যা খ্যাত সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটায় ঢাকা থেকে নদী ও সড়ক উভয় পথেই যাওয়া যায়। ঢাকা সদরঘাট থেকে লঞ্চে বরিশাল বা পটুয়াখালী হয়ে কুয়াকাটা যাওয়া যায়। আর বাসে যেতে চাইলে ঢাকা থেকে সরাসরি কুয়াকাটা যাওয়া যাবে। তবে বিগত দিনে ফেরির ঝামেলা থাকায় অনেক কষ্ট হতো বর্তমানে পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় সে বিড়ম্বনায় আর পরতে হচ্ছে না। মাত্র ৫ থেকে ৬ ঘণ্টায় যাওয়া যাবে সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটায় যা কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে যাবার সময়ের তিন ভাগের এক ভাগ সময়ের মধ্যেই।
সময় ও আরামের কথা বিবেচনা করলে কুয়াকাটা নদী পথে যাওয়া যায়। ঢাকার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে লঞ্চে করে পটুয়াখালী, সেখান থেকে বাসে কুয়াকাটা যাওয়া যায়।
কুয়াকাটার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান
কুয়াকাটার কুয়া : কুয়াকাটা নামকরণের পেছনে যে ইতিহাস আছে সেই ইতিহাসের সাক্ষী কুয়াটি এখনও আছে। এই কুয়াটি দেখতে হলে আপনাকে যেতে হবে রাখাইনদের বাসস্থল কেরাণিপাড়ায়। এ পাড়ায় প্রবেশ করতেই প্রাচীন এ কুয়া দেখতে পাবেন। কথিত আছে ১৭৮৪ সালে মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে রাখাইনরা বঙ্গোপসাগরের তীরে রাঙ্গাবালি দ্বীপে এসে আশ্রয় নেয়। সাগরের লোনা জল ব্যবহারের অনুপযোগী হওয়ায় তারা এখানে মিষ্টি পানির জন্য কূপ খনন করে সে থেকে জায়গাটি ধীরে ধীরে কুয়াকাটা নামে পরিচিত হয়ে উঠে।
সীমা বৌদ্ধ মন্দির: কুয়াকাটার প্রাচীন কুয়ার একটু সামনেই সীমা বৌদ্ধ মন্দিরের অবস্থান। কয়েক বছর আগে কাঠের তৈরি এই মন্দির ভেঙে দালান তৈরি করা হয়েছে। এই মন্দিরের মধ্যে রয়েছে প্রায় ৩৭ মণ ওজনের অষ্টধাতুর তৈরি একটি প্রাচীন বৌদ্ধ মূর্তি।
কেরানিপাড়া : সীমা বৌদ্ধ মন্দিরের রাস্তা ধরে একটু এগিয়ে গেলেই রাখাইনদের আবাসস্থল কেরানিপাড়া। রাখাইন নারীরা কাপড় বুননে বেশ দক্ষ এবং তাদের তৈরি শীতের চাদর খুবই আকর্ষণীয়।
ফাতরার বন: সমুদ্র সৈকতের পশ্চিম দিকে অবস্থিত নদীর অন্য পার থেকে ফাতরার বন শুরু। এ বনের রয়েছে সুন্দরবনের প্রায় সকল বৈশিষ্ট্য। এখানে বন মোরগ, বানর, বুনো শুকর ও নানান পাখি পাওয়া যায়। কুয়াকাটা থেকে ফাতরার বনে যেতে হলে আপনাকে ইঞ্জিন নৌকা ভাড়া করতে হবে।
শুঁটকি পল্লী : জেলে পল্লীর অবস্থান কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের পশ্চিম প্রান্তে। এখানে মূলত নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত শুঁটকি তৈরির মৌসুম চলে। সমুদ্র থেকে মাছ ধরে সৈকতের পাশেই শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করা হয়। চাইলে জেলেদের এই কর্মব্যস্ততা দেখে সময় কাটাতে পারেন। আর কম দামে কিনে নিতে পারেন বিভিন্ন ধরণের পছন্দের শুঁটকি।
লাল কাঁকড়ার চর : কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত ধরে পূর্ব দিকে অনেকটা দূর পর্যন্ত এগিয়ে গেলে লাল কাঁকড়ার চর চোখে পড়বে। এখানে নির্জন সৈকতে ঘুরে বেড়ায় হাজার হাজার লাল কাঁকড়ার দল। ভ্রমণ মৌসুমের সময় অর্থাৎ অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত থেকে লাল কাঁকড়ার চরে যাওয়া যায়।
গঙ্গামতির জঙ্গল: পূর্ব দিকে গঙ্গামতির খাল পর্যন্ত এসে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত শেষ হয়েছে। আর এই জায়গা থেকেই গঙ্গামতির জঙ্গল শুরু। বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা ছাড়াও এই জঙ্গলে দেখা মিলে বিভিন্ন রকম পাখি, বন মোরগ-মুরগি,বানর ইত্যাদি পশুপাখির। অনেকের কাছে এই জঙ্গল গজমতির জঙ্গল হিসাবে পরিচিত।