
গত এক বছরে সোয়া লাখ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ভ্যাট নিবন্ধন নিয়েছে। এতে দেশে ভ্যাট নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে এখন প্রায় তিন লাখে পৌঁছে গেছে। এক বছর ধরে দেশের সব বিভাগীয় শহর, জেলা শহর, পৌরসভার বিপণিবিতানে জরিপ করে এসব প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পেয়েছে ভ্যাট বিভাগ। এত দিন এসব প্রতিষ্ঠান ভ্যাট দিত না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
২০২০ সালের জুলাই মাস থেকে দেশের সবগুলো ভ্যাট কমিশনারেট নিজ নিজ এলাকায় নতুন ভ্যাটযোগ্য প্রতিষ্ঠানের খোঁজে নামে। বছরজুড়ে ওই ১১টি কমিশনারেটের কর্মকর্তারা বিভিন্ন বিপণিবিতানে যান। কোন কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা দোকানের ভ্যাট নিবন্ধন নেই, তা নিয়ে জরিপ করেন ভ্যাট কর্মকর্তারা। জরিপে যাঁদের বেচাকেনা ভ্যাটযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে, তাঁদের ব্যবসা শনাক্তকরণ নম্বর (বিআইএন) বা ভ্যাটের নিবন্ধন দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর মধ্যে কেউ কেউ স্বেচ্ছায় নিয়েছেন। তবে ৬০-৬৫ শতাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে বাধ্যতামূলকভাবে ভ্যাট নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা বাধ্যতামূলক নিবন্ধন দিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানের বেচাকেনা কিছুদিন নজরদারিতে রাখেন
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে দেশে ১ লাখ ৬৭ হাজার ১৬৯টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ভ্যাট নিবন্ধন ছিল। গত ২০২০–২১ অর্থবছরে জরিপের আওতায় ১ লাখ ১৫ হাজার ৩১টি প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাট নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। গত জুন শেষে ভ্যাট নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮২ হাজার ২০০টিতে। এনবিআরের সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য থেকে এ চিত্র পাওয়া গেছে। গত জুলাই মাসে আরও ছয় হাজার প্রতিষ্ঠান এ নিবন্ধন নিয়েছে।
তবে জোরজবরদস্তি করে ভ্যাট নিবন্ধন দেওয়ার অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সম্প্রতি আমি মুন্সিগঞ্জ গিয়েছিলাম। মুন্সিগঞ্জ শহরে সাড়ে তিন শ প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাট নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় ভ্যাট কর্মকর্তারা অনেকটা জোর করেই নিবন্ধন দিয়েছে। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ওই শহরে ২০টির বেশি দোকান ভ্যাটের আওতায় আসার মতো না।’ তিনি আরও বলেন, ব্যবসায়ীরা ভ্যাট দিতে চান। কিন্তু ভ্যাট দেওয়ার পরিবেশ, ভ্যাটের মেশিন—এসব দিতে হবে।
নতুন দুই-তৃতীয়াংশ প্রতিষ্ঠানই ঢাকার
গত এক বছরে যত প্রতিষ্ঠান ভ্যাটের আওতায় এসেছে, তাদের দুই-তৃতীয়াংশ প্রতিষ্ঠানই ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকার। ঢাকার চারটি কমিশনারেট সব মিলিয়ে ৭৬ হাজারের বেশি নতুন প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাটের আওতায় এনেছে। তবে এককভাবে একটি কমিশনারেট হিসাবে ঢাকা দক্ষিণ কমিশনারেটে ৩৮ হাজার ৯২টি প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাট নিবন্ধন দিয়েছে। এই কমিশনারেট সূত্রে জানা গেছে, পুরান ঢাকার বিপুলসংখ্যক প্রতিষ্ঠান এবার ভ্যাটের আওতায় এসেছে।
ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরে দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও নতুন করে অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভ্যাটের আওতায় এসেছে। এ কাজে এগিয়ে আছে খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, কুমিল্লার মতো ভ্যাট কমিশনারেটগুলো। এসব কমিশনারেটে নতুন ভ্যাট নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান বেড়েছে ৫০ শতাংশের বেশি। কুমিল্লা ভ্যাট কমিশনারেটের আওতাধীন কুমিল্লা, নোয়াখালী, চাঁদপুর, ফেনী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় ২০২০-২১ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৩ হাজার ৫৯৩টি প্রতিষ্ঠান ভ্যাটের আওতায় এসেছে। এর ফলে অর্থবছর শেষে কুমিল্লা ভ্যাট কমিশনারেটের নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ হাজার ৬০৬টিতে। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৯৭-৯৮ শতাংশ অনলাইনে ভ্যাট রিটার্ন দেয়।
জানতে চাইলে কুমিল্লা ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনার বেলাল হোসাইন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘কুমিল্লা সিটি করপোরেশনসহ যেসব
সংস্থা ব্যবসার লাইসেন্স দেয়, সেসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছি। এরপর আমাদের ভ্যাট কর্মকর্তারা ওই প্রতিষ্ঠান বা বিপণিবিতানে গেছেন। ভ্যাট নিবন্ধন নেওয়ার জন্য বুঝিয়েছেন তাঁরা। আমরা বিভিন্ন স্থানে সপ্তাহব্যাপী ওয়ান–স্টপ সেবা দিয়েছি। কেউ স্বেচ্ছায় নিয়েছেন। আবার ভ্যাটযোগ্য লেনদেন থাকা সত্ত্বেও যাঁরা নিবন্ধন নেননি, তাঁদের অনেকটা বাধ্যতামূলক নিবন্ধন দিয়েছি। এরপর প্রতিষ্ঠানের বেচাকেনা তদারক করেছি।’
২০১৯ সালের জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন চালু হয়। নতুন আইনে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় ভ্যাট আদায়ে জোর দেওয়া হয়েছে। ভ্যাটের ভিত্তি বাড়াতে ভ্যাট নিবন্ধন দেওয়ার জন্য গত অর্থবছরের প্রথম মাস থেকে কার্যক্রম শুরু করে সব মাঠপর্যায়ের ভ্যাট অফিসগুলো।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, এক বছরের মধ্যে এক লাখের বেশি প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাটের আওতায় আনা অবশ্যই ভালো খবর। চ্যালেঞ্জ হলো এসব প্রতিষ্ঠান নিয়মিত রিটার্ন দিচ্ছে কি না, তা তদারক করা। পাশাপাশি নতুন ভ্যাট আইনের আলোকে এসব প্রতিষ্ঠানকে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় হিসাব-নিকাশ রাখা, রিটার্ন জমা, ভ্যাট পরিশোধে উৎসাহিত করতে হবে। এ ছাড়া প্রতিবছর বিভিন্ন খাতে যে ভ্যাট হার পরিবর্তন করা হয়, তা সঙ্গে সঙ্গে কার্যকরের জন্য ভ্যাটের মেশিনের সফটওয়্যার হালনাগাদ করছে কি না, তা–ও নজরে রাখতে হবে।