
১৯৪৭ এ দেশভাগের পর ভারতের গুজরাট থেকে বাংলাদেশে আসে আজিজ মোহাম্মদের পরিবার । ধনাঢ্য এই পরিবার বসবাস শুরু করে পুরান ঢাকার আরমানিটোলায়। সেখানেই ১৯৬২ সালে জন্ম হয় আজিজ মোহম্মদ ভাইয়ের। তাদের পরিবার মূলত পারস্য বংশোদ্ভুত। এবং ‘বাহাইয়ান’ সম্প্রদায়ের লোক।
‘বাহাইয়ান’কে সংক্ষেপে ‘বাহাই’বলা হয়। এই উপমহাদেশের উচ্চারণে ‘বাহাই’ পরবর্তীতে ‘ভাই’শব্দে পরিণত হয়। এরপর থেকে তাদের বংশের নারী-পুরুষ সবার নামের শেষে ভাই শব্দ যোগ হয়।
পারিবারিকসূত্রে ধনাঢ্য আজিজ মোহাম্মদের অলিম্পিক ব্যাটারী, অলিম্পিক বলপেন, এমবি ফার্মাসিটিউক্যাল, এমবি ফিল্ম, টিপ বিস্কুট, এনার্জি বিস্কুটসহ নানা ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এছাড়া মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, হংকং, সিঙ্গাপুরে তার হোটেল রিসোর্টের ব্যবসা আছে। এসবের পাশাপাশি প্রায় ৫০ চলচ্চিত্রও প্রযোজনা করেছেন তিনি।
তথ্য বলছে, তার বিরুদ্ধে হত্যা ও মাদক পাচারসহ বেশ কয়েকটি গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগে গা ঢাকা দিতে বর্তমানে স্বপরিবারে থাইল্যান্ডে থাকেন আজিজ মোহাম্মদ। সেখানে থেকেই বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনা করেন। তার স্ত্রী নওরিন মোহাম্মদ ভাই দেশে এসে ব্যবসা দেখেন বলে জানা যায়। আজিজ-নওরিন দম্পতির ৩ ছেলে ও ২ মেয়ে।
নব্বই দশকে সিনেমায় অর্থলগ্নির সুবাদে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সাথে নায়ক সালমান শাহ’র পরিবারের সখ্যতা গড়ে উঠে। জনশ্রুতি আছে, সেসময় একটি পার্টিতে নায়ক সালমান শাহ স্ত্রী সামিরা চৌধুরীসহ উপস্থিত ছিলেন। সেই পার্টির এক পর্যায়ে সালমানের স্ত্রী সামিরাকে চুমু খেতে চান আজিজ মোহাম্মদ। ওই সময় সালমান ক্ষিপ্ত হয়ে আজিজ মোহাম্মদকে চড় মারেন।
এর এক সপ্তাহ পর রহস্যজনক মৃত্যু হয় সালমান শাহ’র। প্রাথমিকভাবে আত্মহত্যা বলা হলেও গুঞ্জন উঠে এটি একটি হত্যাকাণ্ড। তখনই চড় দেয়ার ব্যাপারটি আলোচিত হয়। ধারণা করা হয়, আজিজ মোহাম্মদ হয়তো সালমানের মৃত্যুর সাথে কোনোভাবে জড়িত।
সালমান শাহ মৃত্যুর বছরখানেকের ব্যবধানে গুলিতে নিহত হন ঢাকায় চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় আরেক নায়ক সোহেল চৌধুরী। এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে স্বাক্ষীদের জবানবন্দিতে স্পষ্ট হয়েছিলো আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের নির্দেশে হত্যা করা হয়েছিলো নায়ক সোহেল চৌধুরীকে।
বনানীর আবেদিন টাওয়ারে টাম্প ক্লাবে ১৯৯৮ সালের আগে কথিত এক বান্ধবীকে নিয়ে ওই ক্লাবের মধ্যে সোহেল চৌধুরীর সঙ্গে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের কথা কাটাকাটি হয়। তখন উত্তেজিত হয়ে সোহেল ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে গালিগালাজ করেন। তার প্রতিশোধ হিসেবেই হত্যা করা হয় সোহেলকে, এমনটাই উঠে আসে মামলার তদন্তে ।
সোহেল চৌধুরী হত্যাকাণ্ডে আলোচিত ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদকে গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেপ্তারও করেছিলো। তবে অজানা কারণে বেশিদিন কারাগারে রাখা সম্ভব হয়নি তাকে।
প্রয়াত প্রেসিডেন্ট এরশাদের কথিত স্ত্রী মেরির প্রতিও আকৃষ্ট ছিলেন আজিজ মোহাম্মদ। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে গ্রেফতার করিয়ে জেলে পাঠিয়েছিলেন এরশাদ, এমন মুখরোচক গল্পও প্রচলিত আছে আজিজের নামে।
কথিত রয়েছে- মিডিয়ার অনেক তরুণীর সাথে তার অন্তরঙ্গ সম্পর্কের গল্প। এতসব কাণ্ডের কারণেই আজিজ মোহাম্মাদ ভাইকে বলা হয় আন্ডারওয়ার্ল্ডের গডফাদার। তবে মিডিয়ায় আলোচনা এবং তাকে ঘিরে মিথ পছন্দ করতেন আজিজ মোহাম্মদ। প্রায়ই বলতেন, এতো লোকের মাঝে আমাকেই গডফাদার বলা হয়, তাই বা কম কিসে!
২০১৮ সালে শেয়ার কেলেঙ্কারির অভিযোগে আজিজ মোহাম্মদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা ইস্যু করে শেয়ার বাজার বিষয়ক বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. আকবর আলী শেখ। এরপর থেকে বাংলাদেশে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি এই আজিজকে।
৬০ বছর বয়সী এই রহস্য মানবের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ সেসবের ভিত্তিতে কখনো তাকে শাস্তি দেয়া যাবে নাকি নিজেকে সবসময় নির্দোষ দাবী করে চলা এই ‘ডন’ বা ‘গডফাদার’ ধড়া- ছো্ওয়ার বাইরেই থেকে যাবে, সেটা সময়ই বলে দিবে।